বরিশাল কেন্দ্রীয় শহিদ মিনার প্রাঙ্গণে চারুকলার দেয়ালচিত্রে ফুটে উঠেছে তরুণ সমাজের সোস্যাল মিডিয়ায় ভাষা বিকৃতি |
সোহানুর রহমান : ‘বাহান্নতে মুখের ভাষা কিনছি বুকের খুনে রে/ বরকতেরা রক্ত দিছে বিশ্ব অবাক শুনে রে,/ দিছি রক্ত জন্মাবধি সাগর-সাগর নদী-নদী/ রক্তে বাংলা লাল কইরাছি এই কথা তো মিথ্যা নয়।/ দাম দিয়ে কিনেছি বাংলা কারো দানে পাওয়া নয়/ দাম দিছি প্রাণ লক্ষকোটি জানা আছে জগৎময়।’’- গীতিকার ও সুরকার আবদুল লতিফের এই গানটিই বলে দেয় কতটা গর্বের ধন আ’মরি বাংলা ভাষা।
গোটা ধরীত্রির বহু ভাষাভাষীর মধ্যে শুধুমাত্র আমাদের বাঙলিরাই বুকের তাজা রক্ত দিয়ে মায়ের ভাষায় মুখের কথা বলার অধিকার আদায় করে গড়েছে সোনালী ইতিহাস। শেকল ভাঙা টগবগে বাংলা মায়ের দামাল ছেলের দল ১৩৫৯ বঙ্গাব্দের ৮ই ফাল্গুন অর্থাৎ ১৯৫২’র একুশে ফেব্রুয়ারি সকালে সকল বাধা-বিপত্তি আর ভয়কে জয় করে রাজপথে নেমেছিল বলেই আজ আমরা গর্বের সাথে বলতে পারি, ‘আমি বাংলাভাষী, বাংলা আমার মাতৃভাষা।’
ভাষা আন্দোলনের মাধ্যমে যে সংগ্রাম গোড়া পত্তন হয়েছিল তা শিক্ষা আন্দোলন, ৬ দফার স্বাধীকার আন্দোলণ হয়ে রুপ নেয় স্বাধীনতাযুদ্ধে। শেষাবধি ১৯৭১-এ নয় মাসের রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধের পর নতুন দেশ গঠনের মধ্য দিয়ে শেষ হয়। প্রতিষ্ঠিত হয় বাংলাদেশ নামে নতুন এক মানচিত্র। আমরা স্বাধীনতাযুদ্ধে বিজয় লাভ করে একটি স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্রের নাগরিক হওয়ার যোগ্যতা অর্জন করি।
১৯৯৯ সালের ১৭ নভেম্বর ইউনোস্কো ২১ ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে স্বীকৃতি দেয়ায় ভৌগোলিক সীমারেখা অতিক্রম করে পৃথিবীর সব জাতি-গোষ্ঠীর মধ্যে দিয়ে মাতৃভাষা বাংলার জন্য বাঙালির আত্মত্যাগের মহিমা ছড়িয়ে পড়েছে।
সাত’শ কোটির অধিক মানুষের হাজারো ভাষার মধ্যে বাংলা আজ অন্যতম শ্রেষ্ঠ ভাষা। যে ভাষায় বাংলাদেশ, ভারত, পশ্চিমবঙ্গ, আসামসহ কিছু এলাকায় বাংলাভাষী সহ পৃথিবীর প্রায় ২৫ কোটি মানুষ এ ভাষায় কথা বলে মনের ভাব প্রকাশ করে। বিশ্ব জুড়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা আরও বেশ সংখ্যক প্রবাসী বাংলাভাষীতো রয়েছেনই।
তবে সুখের বিষয় হচ্ছে, বর্তমানে বাংলাদেশ ছাড়াও আফ্রিকার একটি দেশ সিওরিলিওনে রাষ্ট্র ভাষা হিসেবে স্বীকৃত আ’মরি বাংলাভাষা।
হানাদার পাকিস্তানিরা নানা কৌশলে সংখ্যাগরিষ্ঠ উর্দু চাপিয়ে দিতে চেয়েছিল, আমরা রক্ত দিয়ে তা প্রতিহত করেছি। সে কথা যেমনি সত্য, তবে সমৃদ্ধ ভাষা আন্দোলনের মাধ্যমে যে রক্তেজেতা বর্ণমালা পেয়েছিলাম তার দুরাবস্থা এখন আমাদের সবার বিস্ময়ের কারণ।
ভাষা হিসেবে বাংলারতো একটা প্রকৃত রূপ বা মান রয়েছে। সেই মান সাহিত্যের ভাষা, শিষ্টাচারের ভাষা, ভদ্র কথপোকথনের ভাষা, লেখাপড়ার ভাষা। আমরা ভুলে যেতে বসেছি যে শুদ্ধ ও পরিশীলিত ভাষা চর্চা করা আবশ্যক। যে যেভাবে পারছে বাংলাভাষার বারটা বাজাচ্ছে।
মোটকথা হচ্ছে, এতো দিনেও আমরা দেশের সর্বত্র বিশুদ্ধ ভাষা চর্চার কোনো কাঠামো গড়ে তুলতে পারিনি। এবারকার প্রাথমিক সমাপনী পরীক্ষার ফল পর্যালোচনা করে দেখা গেছে শিশুরা বাংলার চেয়ে ইংরেজীতে ভালো করছে। বিষয়টি আসলেই উদ্বেগের। তবে বাস্তবতা ভিন্ন।
বাংলা মাধ্যমে পড়াশোনা করবেন, দাম নেই। বাংলায় স্নাতকোত্তর করবেন, ভালো চাকুরী নেই। উচ্চ আদালতে বিচার চাইলেও এর রায়টা পর্যন্ত বাংলায় পাবেন না। ইংরেজী থেকে অনুবাদ করে বুঝে নিতে হবে।
আর বাংলায় কথা বলবেন কিংবা ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিলেনতো আপনার নিজেরই সব ‘ইস্মাটনেস’ আর ‘সোস্যাল স্ট্যাটাস’ চুলোয় যাবে। এমন এক করুন পরিস্থিতে তরুণদের কাছে টানতে এক জগাখিচুরি বাংলার আশ্রয় নিচ্ছে গণমাধ্যম বিশেষ করে এফ রেডিও জকিরা।
প্রতীকী ছবি |
উচ্চতর ডিগ্রি অর্জনকারী বা দেশসেরা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে অধ্যয়ন করা তরুণ সমাজ আজকাল আনাড়ি ফেসবুক ব্যবহারকারী বা মূর্খ-অর্ধ শিক্ষিতদের ব্যঙ্গ করতে গিয়ে এখন তারা নিজেরাই উপহাসের পাত্রে পরিণত হতে চলেছে।
তারা বেশ আনন্দ চিত্তে মজা করেই লিখে থাকে ফডু, খিচ্চা, মঞ্চায়, গিবনে, হপে, খিচাইছে এমন সব উদ্ভট শব্দ স্ট্যাটাস-কমেন্টে থাকে প্রায় নিয়মিত, যা ভবিষ্যৎ প্রজন্ম ধরেই নেবে এটাও ভাষা বাংলা। এই বাংলিশ ভাষারীতির সাথে গড়ে উঠেছে এক মনগড়া বিকৃত বাংলাভাষার কালচার। যাতে গা ভাসিয়ে দিচ্ছে আমাদের তরুণ প্রজন্ম।
এর সঙ্গে আকাশ সংস্কৃতির প্রভাবে হিন্দির আগ্রাসন খানিকটাতো আছেই। বর্তমানে বাংলাদেশে প্রদর্শিত শতকরা ৮০ ভাগ চ্যানেলে হিন্দিতে অনুষ্ঠান হচ্ছে। আমাদের শিশুরা বুদ হয়ে রয়েছে হিন্দি কার্টুন আর ময়েরা সিরিয়ালে। যার ফলে পরিবারের ছেলে-বুড়ো সবাই মনের অজান্তে হিন্দিতে দক্ষ হয়ে উঠছে। প্রায়শই কথা বলছে হিন্দিতে।
১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের জন্য যারা শহীদ হয়েছেন তারা নিশ্চয়ই এরকম জঘন্যভাবে ভাষার বিকৃতি ঘটুক বা বাংলা অবমূল্যায়িত হোক তা চাননি।
ভাষা আন্দোলন নিয়ে রয়েছে তারুণ্যের বহুমাত্রিক উদ্যোগ বিশ্বের হাতেগোনা যে কয়টি অনুষঙ্গের মাধ্যমে বাংলাদেশের পরিচিতি ছড়িয়ে পড়েছে তার মধ্যে একুশে ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস অন্যতম।
আগামী প্রজন্মকে এ গৌরবান্বিত ইতিহাস সম্পর্কে সঠিক তথ্য প্রদান, মাতৃভাষা চর্চা ও সম্মান অক্ষুন্ন রাখতে এখনই কাজ করতে হবে। বাংলা ভাষার ইতিহাস আমাদের ভুলে গেলে চলবে না।
আমরা যেখানে যে মাধ্যমেই লিখি বা বলি না কেন, অবশ্যই খেয়াল রাখতে হবে ভাষার যেন বিকৃতি না ঘটে। উচ্চ আদালত থেকে বিশ্ববিদ্যালয় কিংবা গণমাধ্যম সর্বস্তরে নিশ্চিত করতে হবে বাংলা ভাষার প্রচলণ।
এছাড়া আঞ্চলিক ভাষার বিকাশ ও সংরক্ষণসহ ক্ষুদ্রজাতিসত্বার মাতৃভাষাকেও দিতে হবে সমান গুরুত্ব। আদিবাসী সন্তানেরা যদি তাদের মাতৃভাষায় পড়াশুনা এবং চাকুরী গ্রহণে সক্ষম হয় তবেই স্বার্থক হবে ৮’ই ফাল্গুনে ভাষা শহীদের আত্মত্যাগ।
পরিশোধ করতে পারব তাদের রক্তের ঋণ। আমাদের সম্মিলিত প্রচেষ্ঠায় বাংলায় যে বিশ্বসভার দাপ্তরিক ভাষার মর্যাদা পাবে সেদিন আর বেশি দূরে নয়।
* লেখকঃ নির্বাহী প্রধান, প্রতীকি যুব সংসদ, বাংলাদেশ
No comments:
Post a Comment